ইস্তিহাজা’ এটি আরবি শব্দ। বাংলায় একে সাদাস্রাব এবং ইংরেজিতে লিউকোরিয়া বলে। আর শরিয়তের পরিভাষায় ইস্তিহাজা বলা হয় নারীর অসুস্থতাজনিত স্রাবকে। অর্থাৎ মাসিক ও নিফাসের নির্ধারিত দিনগুলোর অতিরিক্ত দিনে নারীর জরায়ু থেকে যে রক্ত প্রবাহিত হয় তাকে ইস্তিহাজা বলা হয়।
ইস্তিহাজার স্রাব চেনার উপায়
১. মাসিকের সর্বোচ্চ সীমা তথা ১০ দিন অতিক্রম করার পরও স্রাব চলতে থাকা।
২. মাসিকের সর্বনিম্ন সীমা তথা ৩ দিনের আগেই স্রাব বন্ধ হওয়া।
৩. নিফাসের সর্বোচ্চ সীমা তথা ৪০ দিন অতিক্রম করার পরও স্রাব অব্যাহত থাকা।
৪. তুহুর বা পবিত্রতার সর্বনিম্ন সময় তথা ১৫ দিনের মধ্যে স্রাব চালু হওয়া।
৫. বালেগা হওয়ার পূর্বে তথা ৯ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই স্রাব চালু হওয়া।
৬. ঋতুস্রাবের বয়স (সাধারণত নারীর স্রাব বন্ধ হয় ৫৫ বছর বয়সে) অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এমন বৃদ্ধার স্রাব আসা।
৭. গর্ভাবস্থায় বা বাচ্চা প্রসবের আগে যে রক্ত বা পানি বের হয় বা বাচ্চার অর্ধেকাংশ বের হওয়ার আগ পর্যন্ত যে স্রাব বের হয় তা ইস্তিহাজা।
৮. কোনো নারীর যদি মাসিকের নির্দিষ্ট অভ্যাস থাকে যেমন—পাঁচ বা ছয় দিন, অতঃপর কোনো মাসে তার এই অভ্যাস পার হয়ে ১০ দিন অতিক্রম করে, তাহলে তার নির্দিষ্ট অভ্যাসের পরের দিন থেকে তা ইস্তিহাজা বলে গণ্য হবে।
ইস্তিহাজাগ্রস্ত নারীর প্রকারভেদ
যে নারী ইস্তিহাজাগ্রস্ত তাকে মুস্তাহাজা বলা হয়। মুস্তাহাজা নারী সাধারণ পাঁচ ধরনের—
ক. ইস্তিহাজার মাধ্যমে বালেগা হওয়া। অর্থাৎ জীবনে এটাই তার প্রথম রক্তস্রাব এবং নির্দিষ্ট দিনের কোনো অভ্যাসও নেই। এ অবস্থায় যতক্ষণ পর্যন্ত প্রবাহিত রক্তে কালো বর্ণ অথবা গাঢ় কিংবা কোনো গন্ধ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত মাসের প্রথম ১০ দিন হায়েজ বা মাসিকের বিধান কার্যকর হবে। বাকি ২০ দিন ইস্তিহাজা হিসেবে গণ্য করে তার নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে; যেমন—একজন নারী জীবনে প্রথম লজ্জাস্থানে রক্ত দেখল এবং সে রক্তকে ১০ পর্যন্ত কালো দেখেছে এবং মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে লাল দেখেছে। অথবা ১০ দিন পর্যন্ত গাঢ় ও ঘন ছিল এবং মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে পাতলা ছিল। অথবা ১০ দিন পর্যন্ত তার মধ্যে গন্ধ ছিল এবং তার পরে কোনো গন্ধই থাকেনি, তাহলে প্রথম দৃষ্টান্তে প্রবহমান রক্ত কালো বর্ণ থাকা পর্যন্ত, দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে গাঢ় থাকা পর্যন্ত এবং তৃতীয় দৃষ্টান্তে গন্ধ থাকা পর্যন্ত হায়েজ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর পর থেকে ইস্তিহাজা হিসেবে গণ্য হবে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, নবী (সা.) ফাতেমা বিনতে আবি হুবাইশ (রা.)-কে বলেছেন, যখন হায়েজের রক্ত দেখা দেবে তখন তা কালো বর্ণের হবে, যা চেনা যায়। সুতরাং কালো বর্ণের রক্ত দেখা দিলে নামাজ থেকে বিরত থাকো। আর কালো ছাড়া অন্য কোনো বর্ণ দেখা দিলে অজু করে নামাজ আদায় করো। কেননা তা রগ থেকে বের হয়ে আসা রক্ত। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৮৬)
খ. যে নারীর প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় রক্তস্রাব শুরু হয়ে তা অব্যাহত থাকে এবং এর আগে তার মাসিকও হয়নি, তাহলে ৪০ দিন নিফাস হিসেবে গণ্য করা হবে। নিফাসের পরবর্তী ২০ দিন ইস্তিহাজা বা পবিত্রতা এবং এর পরবর্তী ১০ দিন মাসিক হিসেবে গণ্য করা হবে। এভাবেই তার মাসিক ও পবিত্রতার দিন চলতে থাকবে। আর যদি আগে মাসিক হয়ে থাকে তাহলে ৪০ দিন নিফাসের দিন ধরে নিজ অভ্যাস অনুযায়ী মাসিক ও পবিত্রতা গণ্য করবে।
গ. ইস্তিহাজা বা অনবরত রক্তপ্রবাহ আরম্ভ হওয়ার আগে যদি নারীর প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঋতুস্রাবের অভ্যাস থাকে, তাহলে পূর্বনির্ধারিত সময় পর্যন্ত প্রবহমান রক্তকে হায়েজ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এর ওপর হায়েজের বিধান কার্যকর হবে। নির্দিষ্ট সময়ের পরের রক্তস্রাবকে ইস্তিহাজা গণ্য করে তার বিধান মেনে চলতে হবে। যেমন—একজন নারীর প্রতি মাসের প্রথম দিকে ছয় দিন করে রক্তস্রাব হয়ে থাকে। এখন হঠাৎ করে দেখা গেল যে ওই নারীর অবিরাম রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তাহলে তখন প্রতি মাসের প্রথম ছয় দিনে প্রবাহিত রক্তকে হায়েজ হিসেবে গণ্য করে বাকি সময়কে ইস্তিহাজা হিসেবে ধরে নিতে হবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ (রা.) রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি কখনো পবিত্র হই না। এ অবস্থায় আমি কি সালাত ছেড়ে দেব? নবীজি (সা.) বললেন, এ হলো এক ধরনের বিশেষ রক্ত, হায়েজের রক্ত নয়। যখন তোমার হায়েজ শুরু হয় তখন তুমি সালাত ছেড়ে দাও। আর হায়েজ শেষ হলে রক্ত ধুয়ে সালাত আদায় করো। (বুখারি, হাদিস : ৩০৬)
ঘ. যে নারীর পূর্বে নিফাসের নির্ধারিত মেয়াদ ছিল তার বিধান হলো, রক্ত যদি ৪০ দিনের মধ্যে বন্ধ হয় তাহলে পুরোটাই নিফাসের অন্তর্ভুক্ত। আর ৪০ দিন অতিক্রম করলে পূর্বের নির্ধারিত সময় নিফাস, বাকি সময় ইস্তিহাজা বলে গণ্য হবে।
ঙ. যে নারী মাসিকের দিনগুলোর পরিমাণ বা তারিখ অথবা উভয়টি ভুলে গেছে, তার সাধারণ হুকুম হলো পবিত্রতা এবং হায়েজের সময় বা তারিখ নির্ধারণের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করবে। চিন্তা-ভাবনার পর যখন মাসিকের তারিখ বা দিন নির্ধারণ করবে তখন নামাজ-রোজা বন্ধ রাখবে। আর যখন পবিত্রতার দিন নির্ধারণ করবে তখন প্রতি ওয়াক্তের নামাজের জন্য অজু করে নামাজ পড়বে।
মুস্তাহাজা ও পবিত্র নারীর বিধানে পার্থক্য
ইস্তিহাজার বিধান এবং পবিত্রতার বিধান একই। তবে মুস্তাহাজা নারী এবং পবিত্র নারীর নামাজ ও সহবাসের ক্ষেত্রে কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে—
১. পবিত্র নারীর ওপর যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ, মুস্তাহাজা নারীর ওপরও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। তবে মুস্তাহাজা নারীর জন্য প্রতি নামাজে অজু করা ওয়াজিব।
২. মুস্তাহাজা নারী যখন অজু করার ইচ্ছা করবে তখন রক্তের দাগ ধৌত করে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার রাস্তায় তুলা দিয়ে পট্টি বেঁধে নেবে, যেন ওই তুলা রক্তকে আঁকড়ে ধরে। এ প্রসঙ্গে নবী (সা.) হামনাহ বিনতে জাহাশ (রা.)-কে বলেছেন, ‘আমি তোমাকে লজ্জাস্থানে কুরসুফ তথা ন্যাকড়া বা তুলা ব্যবহার করার উপদেশ দিচ্ছি। কেননা ন্যাকড়া বা তুলা রক্তটা টেনে নেবে। জবাবে হামনাহ (রা.) বললেন, আমার প্রবহমান রক্তের পরিমাণ তদপেক্ষাও বেশি। অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি লজ্জাস্থানে কাপড় ব্যবহার করো। হামনাহ (রা.) বললেন, প্রবহমান রক্তের পরিমাণ তার চেয়ে আরো বেশি। এরপর রাসুল (সা.) হুকুম দিলেন, তুমি তাহলে স্রাব বের হওয়ার স্থানে লাগাম বেঁধে নাও। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৬২৭)
৩. পবিত্র নারীর সঙ্গে যেমন মাসিকের সময় ছাড়া সহবাস জায়েজ, মুস্তাহাজা স্ত্রীর সঙ্গেও সহবাস জায়েজ। কেননা নবী (সা.)-এর যুগে ১০ বা ততোধিক নারী ইস্তিহাজা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। নবীজি (সা.) স্বামীদের সঙ্গে তাঁদের সহবাসের বৈধতা দিয়েছেন। তা ছাড়া পবিত্র কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা হায়েজ অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাকো। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)
এই আয়াতে শুধু নারীর হায়েজ অবস্থায় সহবাসকে নিষেধ করা হয়েছে, অথচ ইস্তিহাজাও পবিত্রতার বিধানের অন্তর্ভুক্ত। তবে কোনো নারী যদি সে সময় সঙ্গমে ক্ষতি বা অস্বস্তি বোধ করে তাহলে অভিজ্ঞ দ্বিনদার ডাক্তারের পরামর্শে চলাই উত্তম। আর দাম্পত্য জীবন সুখময় করার লক্ষ্যে স্ত্রীর সুস্থতা-অসুস্থতা ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। (তিরমিজি, হাদিস: ১২৬, রদ্দুল মুহতার ১/৪৮৪-৪৮৭, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/৯২, বাদায়েউস সানায়ে ১/১৫৮-১৬২
Leave a Reply